নীরব সিম্ফনি: পৃথিবীর ঘূর্ণন ও সূর্য প্রদক্ষিণ — এক মহাজাগতিক স্বাক্ষর


নীরব সিম্ফনি: পৃথিবীর ঘূর্ণন ও সূর্য প্রদক্ষিণ — এক মহাজাগতিক স্বাক্ষর



তুমি যদি একরাশ তারা-পথের অদৃশ্য রেখা ধরে এগিয়ে চলো, দেখবে তা বিশৃঙ্খলা নয়—তা স্মৃতির গান; তা হাহাকার নয়—তা সুরেলা ছন্দ।

“আর কে পৃথিবীকে করল স্থিতিশীল আশ্রয়, এবং তাতে প্রবাহিত করল নদী, স্থাপন করল সুদৃঢ় পর্বতমালা এবং দুই সমুদ্রের মাঝে সৃষ্টি করল এক অনতিক্রম্য প্রতিবন্ধক?”
— সূরা নামল, ২৭:৬১

এই আয়াত যেন এক ধীর অথচ গভীর বজ্রধ্বনি—যা কেবল ঈমানকেই ডাকে না, ডাকে চিন্তাকেও। এটা চোখ বুজে সিজদা দিতে বলে না; বলে চোখ খুলে তাকাও পৃথিবীর দিকে, তাকাও এই নীল গ্রহের নড়াচড়ার দিকে, যেখানে প্রতিটি দোলাচলকে ধরে রেখেছে এক অদৃশ্য হস্ত।



স্থিরতার ভিতরে গতি—এক অভিনব রহস্য

প্রথম দর্শনে পৃথিবী স্থির মনে হয়। আমরা হাঁটি, বাড়ি বানাই, গাছ লাগাই, স্বপ্ন দেখি—সবই এক মসৃণ নির্গমনহীন জমিনে দাঁড়িয়ে। অথচ বাস্তবে, আমরা বসে আছি এক মহাজাগতিক রথে, যা নিজ অক্ষে প্রতি ঘণ্টায় ১৬০০ কিলোমিটার বেগে ঘোরে, আর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে প্রায় ১,০৮,০০০ কিলোমিটার গতিতে।

কাউকে যদি বলা হয়—তুমি এমন এক বাহনে বসে আছো যা কখনো থামে না, বুলেটের চেয়েও দ্রুত চলে—তবে সে নিশ্চয়ই আতঙ্কে চিৎকার করে উঠবে। অথচ এই আতঙ্কের মধ্যেই লুকিয়ে আছে জীবনদানের রহস্য। এই অস্থিরতাই আমাদের জীবনের মূল ভিত। এই গতি-ই আমাদের স্থিরতা। এই দোলন-ই আমাদের শান্তি।

আল্লাহ বলছেন, “কে পৃথিবীকে করল স্থিতিশীল?”—এই স্থিরতা আসলে গতি-র উপর এক ঈশ্বরিক নিয়ন্ত্রণ। পৃথিবী দাঁড়িয়ে নেই—তবুও সে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের কাছে, যেন একটা জাদু।



নদী, পর্বত, আর গ্রহের নৃত্য

আল্লাহ বলেন, “তাতে সৃষ্টি করল নদী”। নদী মানেই প্রাণের শিরা, যা মহাদেশকে আঁকছে, আবহাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এরপর বলা হয়, “এবং করল সুদৃঢ় পর্বতমালা।” এগুলো শুধু প্রকৃতির শোভা নয়—বিজ্ঞানের চোখে পর্বত হল ভূত্বকের পেরেক, যা ভূমিকম্পের প্রবণতা হ্রাস করে। এই কথাগুলো বিজ্ঞানের খাতায় লেখার অনেক আগেই কোরআন তা বলে দিয়েছে।

সবচেয়ে রহস্যময় বিষয়, “দুই সমুদ্রের মাঝে প্রতিবন্ধক”—এটি আধুনিক সমুদ্রবিজ্ঞানে পরিচিত ‘বেরজাখ’। যেখানে দুটি আলাদা ধরণের পানি—লবণাক্ততা ও তাপমাত্রার পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও—মিশে না।

এমনকি আমাদের মহাশূন্য প্রদক্ষিণের মাঝেও, পৃথিবী নিজের ভিতরে তৈরি করে রেখেছে এক নিখুঁত সঙ্গীত, এক সুষমা, যা পুরো জগতের মধ্যে অনন্য।



দেখো না শুধু—ভাবোও

হজরত মির্জা তাহির আহমদ (রহ.) বারবার বলতেন—কোরআন বিজ্ঞানবিষয়ক বই নয়, এটি ‘নিশানাবলী’র কিতাব। আর নিশানা মানেই কেবল দেখা নয়—তা মানা লাগে, অনুসরণ করা লাগে।

এই আয়াতটির ব্যাখ্যা করতে গেলে শুধু বিজ্ঞানের সাথে মিল খুঁজে পাওয়াটাই যথেষ্ট নয়—প্রয়োজন সেই বিস্ময় অনুভব করা, সেই বিনম্রতা হৃদয়ে স্থান দেওয়া। আধুনিক বিজ্ঞান বলে ‘পৃথিবীর ঘূর্ণন ও সূর্য প্রদক্ষিণ’—কোরআন বলে, “স্থিতিশীল পৃথিবী।” এটা পরস্পরবিরোধী নয়—বরং কোরআনের দৃষ্টিভঙ্গি আরো ঊর্ধ্বতন, সম্পূর্ণতর।

এই ঘূর্ণনের কারণেই দিন-রাত্রি আসে। সূর্য প্রদক্ষিণের কারণেই ঋতুবদল হয়। কিন্তু কোরআন আমাদের শেখায়—এই গতির মধ্যেও আছে এক আত্মিক শিক্ষা। পৃথিবীর মতই, একজন সৎ মুমিনও সবসময় চলমান থাকেন, পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেন—তবুও ঈমানের ভিতে থাকে অটল, পৃথিবীর অক্ষরেখার মত।



অর্থবোধে উত্তরণ—জ্ঞান থেকে অনুপ্রেরণ

এই জ্ঞানের যুগে, যেখানে বিজ্ঞান আছে, কিন্তু ঈমান নেই—সেখানে এই আয়াতটি এক মহামূল্যবান চাবিকাঠি। যা বলে—বিজ্ঞানকে ঈশ্বরের পথে নাও, পর্যবেক্ষণকে করো পবিত্র উপলব্ধি।

প্রিয় পাঠক, তুমি কেবল কয়েকটি পরমাণুর সমষ্টি নও। তুমি এক সচেতন আত্মা, যে বসে আছে এক ঘূর্ণায়মান অলৌকিকতায়। তোমার কাজ শুধু ভেসে বেড়ানো নয়—তোমার দরকার তোমার সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হওয়া। ফিরে ফিরে Creator-এর দিকে ঘুরে যাওয়া।

এই আয়াতটি হোক আমাদের নতুন যাত্রার শুরু। শুধুই ঈমানের আলাপ নয়—এটি হোক কাজে রূপান্তরের ডাক। আমাদের যুবক, বিজ্ঞানী, চিন্তাবিদ, মুমিন—সবাই উঠে দাঁড়াক এই আয়াতের আলোয়, সত্যের খোঁজে, সুরের খোঁজে, সৃষ্টির গভীরতায়।

কারণ, পৃথিবীর নিঃশব্দ ঘূর্ণনে এক আওয়াজ বাজে—
“তোমরা কি চিন্তা করো না?”

Leave a Comment