
(সূরা আল-মু’মিনূন, ২৩:১২–১৩)
“আর অবশ্যই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটির নির্যাস থেকে। এরপর আমি তাকে রাখি এক নিরাপদ আশ্রয়ে একটি বীজরূপে।”
(সূরা আল-মু’মিনূন, ২৩:১২–১৩)
আয়াত দুটি পড়তে খুবই সহজ। কিন্তু এই সহজ শব্দগুলোর মধ্যে এমন এক অনন্ত বিস্ময়ের দরজা লুকিয়ে আছে, যা খুললে দেখা যায়—মানুষ কেবল একটি দেহ নয়, এক মহাবিশ্ব। তার শরীরে মাটি আছে, তার কোষে আকাশের খবর আছে। বিজ্ঞানীরা যেটা ল্যাবরেটরিতে বসে হাজার যন্ত্রে খুঁজেছেন, সেটা আল্লাহ্্ চুপিচুপি বলে দিয়েছেন কুরআনের সূক্ষ্ম আয়াতে।
মাটি—তোমার জন্মের গল্প
“আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটির নির্যাস থেকে”—এই বাক্যটা হঠাৎ করে শুনলে অনেকেই ভাবেন এটা কবিতা। হ্যাঁ, এটা কবিতা, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানও। এখানে ‘নির্যাস’ অর্থাৎ ‘সুলালাহ’ শব্দটি এসেছে আরবি থেকে। এর মানে হলো খাঁটি নির্যাস, রস, নির্দিষ্ট কিছু গ্রহণযোগ্য উপাদান।
হযরত মির্যা বশীরউদ্দীন মাহমুদ আহমদ (রা.) তাঁর তাফসীরে লিখেছেন:
> “এখানে কেবল মাটির কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছে, সেই মাটি থেকে নির্যাস বের করে, বেছে, পরিশ্রুত করে আল্লাহ মানুষ বানিয়েছেন।”
আজকের বিজ্ঞানীরা বলেন—মানবদেহে যা যা আছে, যেমন ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন—সবই পৃথিবীর মাটি থেকেই আসে। গম গাছের মাধ্যমে, শাক-সবজি হয়ে, মাছ-মাংস হয়ে তা আমাদের রক্তে চলে আসে।
মাটি মানে শুধু ধুলো নয়। মাটি মানে আমাদের অস্তিত্বের প্রথম পাণ্ডুলিপি।
ফার্ম লজিং—একটি ক্ষুদ্র বিন্দুর মধ্যকার মহাবিশ্ব
এরপর কুরআন বলে—“তাকে একটি বীজরূপে রাখি এক নিরাপদ আশ্রয়ে।”
সেই ‘বীজরূপ’—নুৎফা—অর্থাৎ শুক্রানু বা মানব বীর্য, যা মায়ের গর্ভে প্রবেশ করে আশ্রয় নেয় জরায়ুতে—একটি নিরাপদ ও দৃঢ় স্থান।
একটা বিন্দু—যেটা চোখেও দেখা যায় না—তার মধ্যে লুকিয়ে থাকে চোখ, কান, মন, আত্মা, কবিতা, যুদ্ধ, প্রেম, ইতিহাস, ভবিষ্যৎ। সেই বিন্দু থেকেই সৃষ্টি হয় একজন মানুষ—সে আলাদা, অনন্য।
পবিত্র কুরআন তখন বলছে, এবং আধুনিক জেনেটিক্স বলছে—ডিএনএ নামক এক আশ্চর্য কোডের মাধ্যমে পুরো মানব-মানচিত্র সেই এক বিন্দুতে লুকিয়ে থাকে।
হযরত মির্যা বশীরউদ্দীন মাহমুদ আহমদ (রা.) বলেন:
> “মানুষ কোনো দৈবক্রম নয়। তার পেছনে আছে নিখুঁত পরিকল্পনা, এক মহান সৃষ্টিকর্তার মাস্টারপ্ল্যান।”
মাটি ও আত্মার দ্বৈততা
হযরত মির্যা তাহির আহমদ (রহ.) বারবার বলতেন—এই আয়াত শুধু জীববিদ্যার কথা বলে না। এ আমাদের আত্মাকে ডাকে। আত্মা যেন শোনে—তুমি কোথা থেকে এসেছো, কেন এসেছো।
> “তুমি মাটি থেকে তৈরি, অথচ ভাব ধরেছো ফেরেশতার মতো? তুমি এক ফোঁটা, অথচ ভাবো তুমি অমর? আগে নিজের অস্তিত্বটা বুঝো, তারপর আল্লাহকে চিনো।”
এই কথার মধ্যে একটা ঠাণ্ডা গর্জন আছে। একধরনের শিহরণ। যেন কুরআন তোমাকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে বলে—‘তুমি কে?’
জেগে ওঠো, মাটির মানুষ!
এই আয়াতগুলো আমাদের ভয় দেখাতে আসে না, ছোট করে না। বরং বলে—“তুমি মাটি, হ্যাঁ। কিন্তু সেই মাটি যেটা আমি বেছে নিয়েছি, ভালোবেসে নিয়েছি, আকার দিয়েছি।”
হযরত মির্যা বশীরউদ্দীন মাহমুদ আহমদ (রা.) লিখেছেন:
> “সৃষ্টির এই পথ কেবল একটা জৈবিক বিবরণ নয়। এটা একজন মুমিনের জীবনের প্রতিফলন—শূন্যতা থেকে আত্মিক মহত্ত্বে উত্তরণ।”
এই কথার মানে দাঁড়ায়—আমার ভেতরের কাদা শুকিয়ে যাক, তবেই তো আমি আকাশ স্পর্শ করবো। ভেতরের মাটি যদি জেগে ওঠে, তাহলেই আত্মা তার গন্তব্য চিনবে।
শেষ কথাটি—একটি নরম চাবুক
আধুনিক যুগে আমরা ডিএনএ নিয়ে ব্যস্ত, কম্পিউটার কোড নিয়ে মাতামাতি করছি। অথচ কুরআনের এই ছোট্ট আয়াত দু’টি ডাকে—“এই কোডের পেছনে যিনি কোডার, তাঁকে চেনো।”
হে মাটির তৈরি মানুষ, তুমি কেবল ধুলো নও। তুমি নকশা। তুমি নিখুঁত এক কারুকাজ।
তুমি এক বিন্দু—তবু ভেতরে নিয়ে চলছো আকাশের ভাষা, আরশের প্রজ্ঞা।
তাই উঠো— নিচু মাথা করো নিজের জন্মের কথা ভেবে, আর দৃঢ় পা ফেলো নিজের ভবিষ্যতের দিকে।
তোমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে, এখন তোমার পালা—তুমি মানুষ হও।