🌌 যখন অনন্তকাল নত হয় ন্যায়ের সামনে

সময়ের সঙ্গে আল্লাহর সম্পর্ক কীভাবে ন্যায় ও রহমতের প্রাচীন দ্বন্দ্ব সমাধান দেয়

✍️ সাঈফুল ইসলাম



প্রারম্ভিকা: বৃষ্টির মতো শান্তির আহ্বান

একটি হিমঘন রাত। দূরে দূরে ঝলমল করছে তারারা। মানুষের মনে আসে এক প্রশ্ন—এক চিরন্তন সত্তা কীভাবে সীমিত মানুষের প্রতি ন্যায়পরায়ণ হতে পারেন?

যতবার মানুষ সময়ের স্রোতের ধারা লক্ষ্য করে, সে অনুভব করে ক্ষয়, ব্যর্থতা, অনিশ্চয়তা। সে ভাবতে বাধ্য হয়—“আমি কি ঠিক করেছি, কি ভুল করেছি?”

কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে সময়ের কোনো বাঁধা নেই। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ—সব মিলেমিশে এক চিরন্তন উপস্থিতিতে বিস্তৃত। এখানে বেদনা কেবল চিহ্ন নয়; এটি প্রেরণার এক সেতু। প্রতিটি শোকই চিরন্তন ভালোবাসার এক উজ্জ্বল রেখা।

> “যে বেদনা তুমি অনুভব কর, তা শুধুই ক্ষণস্থায়ী নয়—এটি চিরন্তন ভালোবাসার গল্পের এক অংশ।”





১. সময়ের নদীর ওপারে অনন্তের রহস্য

মানুষ সময়ের সঙ্কীর্ণ করিডোরে হাঁটে—
পেছনে অতীত, সামনে ভবিষ্যৎ, এবং বর্তমান ক্রমশ বিলীন।

কিন্তু আল্লাহ—তিনি অনন্ত।
তিনি সময়ের স্রষ্টা, তাই সময় তাঁকে বাঁধতে পারে না।

দার্শনিকেরা কল্পনা করেছেন এমন ঈশ্বরের, যিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এক অবিভাজ্য “এখন”-এ দেখেন। সমালোচকেরা প্রশ্ন তোলে:
“তাহলে এমন এক ঈশ্বর কীভাবে ভালোবাসেন, প্রতিক্রিয়া জানান, বা কাজ করেন?”

কিন্তু ভুলটি বোঝার মূল: এই জগতের অস্তিত্বই প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর ইচ্ছার ফসল। সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সময়ের সম্পর্ক যান্ত্রিক নয়, বরং সার্বভৌম। যখন তিনি বলেন “হও”, তখন সময় নিজেই জন্মায়।



২. ন্যায়ের জটিলতা: ক্ষণস্থায়ী পাপের চিরন্তন পরিণাম

আধুনিক ধর্মতত্ত্বে একটি চিরন্তন প্রশ্ন:
যদি পাপ সময়ের মধ্যে সংঘটিত হয়, তবে তার শাস্তি চিরন্তন কেন?

মানুষের সীমিত চোখে তা বেমানান মনে হয়। ষাট বছরের অবাধ্যতা কি অনন্ত শাস্তির যোগ্য?

কিন্তু ভুল হচ্ছে—সময়সূচকতা Nature-এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা।
পাপ কোনো একক ঘটনা নয়, এটি আত্মার এক বিকৃত অবস্থা।
যে ব্যক্তি ঈশ্বরের বিরুদ্ধে জীবন শেষ করে, তার ইচ্ছা স্থায়ীভাবে বিকল। সে শুধু ভুল করে না—সে নিজেই ভুল হয়ে যায়।

> জাহান্নামের আগুন কোনো ক্রুদ্ধ দেবতার শাস্তি নয়;
এটি বিকৃত আত্মার অন্তর্গত সত্য, যা আল্লাহর আলোয় প্রকাশ পেয়ে যন্ত্রণা হয়ে ওঠে।



শাস্তি কাকতালীয় নয়; এটি স্ব-উন্মোচন। এর স্থায়িত্ব নির্ধারণ করে আত্মার চিরস্থায়ী প্রবণতা।




৩. অনন্তের ছায়ায় রহমতের আলো

আল্লাহর ন্যায়বিচার কখনো রহমত থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।

> “আমার রহমত সর্ববস্তুকে পরিব্যাপ্ত করেছে।”
(সূরা আ’রাফ ৭:১৫৭)



পাপের আগে, পাপের মধ্যে, ও পরে রহমত চিরন্তনভাবে বিদ্যমান।
মানব প্রত্যাখ্যান রহমতকে মুছে দেয় না, শুধু আড়াল করে।

হযরত মির্জা বশিরউদ্দিন মাহমূদ আহমদ (রাঃ) ব্যাখ্যা করেছেন—
আল্লাহর সব গুণাবলী ভারসাম্যে কাজ করে। কোনো শাস্তি করুণাহীন নয়,
আর কোনো রহমত ন্যায়ের সীমা অতিক্রম করে না।

বিশ্বাসীর জন্য এই ভারসাম্যই শান্তির উৎস।
জীবনের অস্থায়ী বেদনাও বৃথা নয়—
এটি চিরস্থায়ী কল্যাণের সেতু।

> “তারা বলবে, সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর, যিনি আমাদের সকল দুঃখ দূর করেছেন।”
(সূরা ফাতির ৩৫:৩৫)



এটি ভুলে যাওয়ার নয়; এটি রূপান্তরের গল্প। দুঃখ নিজেই আলোয় পরিণত হয়, আত্মার উত্থানের হাতিয়ার হয়ে ওঠে।



৪. অতিকায় কল্যাণের তত্ত্ব

দর্শন suffering ও reward-কে যুক্তির দাঁড়িপাল্লায় মাপে।
ওহি মাপে এগুলো ভালোবাসার গভীরতায়।

আল্লাহর ন্যায়ের আইনে প্রতিদান সমানুপাতিক নয়—
এটি অতিপ্রাচুর্যে পূর্ণ।

পরকালীন জীবনে আল্লাহর সান্নিধ্য থেকে যে আনন্দ আসে,
তা এত অপরিমেয় যে পৃথিবীর সমস্ত দুঃখ তুচ্ছ হয়ে যায়।

পরীক্ষার আগুন আত্মাকে পরিশোধন করে,
যেন সোনার ভেতরের অমেধ্য দূর হয়।
যখন বিশ্বাসী আল্লাহর সম্মুখে দাঁড়ায়,
তার প্রতিটি বেদনাই চিরন্তন আনন্দের বুনটে অপরিহার্য সুতায় পরিণত হয়।



৫. যুক্তি ও ওহির মিলন

মানববুদ্ধি একা অনন্তের রহস্য ধরতে পারে না।
বুদ্ধি চায় ধারাবাহিকতা;
ওহি প্রকাশ করে ঐক্য।

চিরন্তন আল্লাহ কোনো নিষ্ক্রিয় পর্যবেক্ষক নন—
তিনি জীবন্ত উপস্থিতি,
যিনি প্রতিটি মুহূর্তে ক্রিয়াশীল।

তিনি পাপীর অনুশোচনায় আছেন,
শোকাহত হৃদয়ে আছেন,
মুমিনের দোয়ায় আছেন।

তাঁর কালাতীততা তাঁকে দূরে সরায় না—
বরং অনন্ত নৈকট্যে রাখে।

নবীগণ যুক্তিকে নীরব করতে আসেননি—
তারা এসেছেন তাকে বিনয় শেখাতে।
কারণ ভালোবাসাহীন যুক্তি হয়ে ওঠে নিষ্ঠুর।



৬. চূড়ান্ত ঐক্য: ভালোবাসা—অনন্তের বিধান

সব তর্ক, সব যুক্তির শেষে একটিই সত্য অমলিন—
চিরন্তনতা নত হয় আল্লাহর ভালোবাসার সামনে।

আল্লাহর কালাতীততা ন্যায়ের প্রতিবন্ধক নয়—
বরং সেটিই ন্যায়ের পরম নিশ্চয়তা।

কারণ তিনি সময়ের ঊর্ধ্বে—
কোনো সৎকর্ম তাঁর দৃষ্টির বাইরে হারায় না,
কোনো দোয়া অতীতে মিলিয়ে যায় না,
কোনো বেদনা বিস্মৃত হয় না।

চিরন্তন শাস্তির কথিত “সমস্যা” মুছে যায়,
যখন বোঝা যায়—চিরকাল মানে সময় নয়, অবস্থা।

যে আত্মা আলোকে বেছে নেয়, সে আলোতেই অনন্তকাল থাকে;
যে আত্মা অন্ধকারকে ভালোবাসে, সে অন্ধকারেই স্থির হয়।

> আল্লাহর ন্যায় শীতল যুক্তি নয়—
এটি জীবন্ত রহমত।
তাঁর রহমত কোনো আবেগী নমনীয়তা নয়—
এটি চিরন্তন ন্যায়।



এই চিরসুষম ভারসাম্যেই নিহিত আল্লাহর পরিপূর্ণতা।

> “আর যখন তিনি কোনো বিষয় ইচ্ছা করেন, তখন তিনি বলেন, ‘হও’, আর সেটি হয়ে যায়।”
(সূরা ইয়াসিন ৩৬:৮২)





✨ উপসংহার: হৃদয়ের নিঃশ্বাসে চিরন্তন প্রেম

প্রতিটি বেদনা শুধুই গল্প নয়,
প্রতিটি কষ্টে লুকিয়ে আছে আল্লাহর রহমতের সুর।
চিরন্তনতা মানে সময় নয়—এটি অবস্থা, প্রেমের এক চিরস্থায়ী প্রকাশ।
সেই মুহূর্তেই আত্মা শান্তি পায়,
বেদনা আলোয় রূপান্তরিত হয়,
নিষ্ঠুরতা প্রেমে পরিণত হয়,
আর ন্যায় ও রহমত এক হয়ে যায় এক অপূর্ব সুরে।