পুঁজিবাদ ও কমিউনিজমের বাইরে: ১৯৪২ সালের এক বক্তৃতায় লুকিয়ে থাকা নতুন বিশ্বব্যবব্যবস্থা

আজকের পৃথিবীতে পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র, কমিউনিজম—নানা রকমের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক আর সংঘাত লেগেই আছে। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য এক জ্বলন্ত সমস্যা, যার কোনো স্থায়ী সমাধান যেন মিলছে না। একদিকে সীমাহীন সম্পদ, অন্যদিকে চরম দারিদ্র্য—এই দৃশ্য আমাদের সবার পরিচিত।

কিন্তু ভাবুন তো, আজ থেকে প্রায় ৮০ বছর আগে, ১৯৪২ সালে, যখন পৃথিবী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগুনে পুড়ছিল, তখন এক বক্তা এই সমস্যাগুলোর এক অসাধারণ বিশ্লেষণ করেছিলেন এবং এক সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের “নতুন বিশ্বব্যবস্থা”র ধারণা দিয়েছিলেন। তিনি হলেন হযরত মির্জা বশিরুদ্দিন মাহমুদ আহমদ। তার সেই বক্তৃতাটি আজকের দিনেও আশ্চর্যজনকভাবে প্রাসঙ্গিক। চলুন, সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতা থেকে এমন কিছু যুগান্তকারী ধারণা জেনে নেওয়া যাক, যা আজকের বিশ্বেও আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখাবে।

এক ভবিষ্যদ্বাণী: সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কারণগুলো লেখা হয়েছিল বহু আগেই

আজকের দিনে কমিউনিজমের পতন এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা, কিন্তু ১৯৪২ সালেই এর ভেতরের মারাত্মক দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছিল। বক্তা বলশেভিক বা কমিউনিস্ট ব্যবস্থার যে সমালোচনা করেছিলেন, তা ছিল অত্যন্ত দূরদর্শী।

তার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই ব্যবস্থার মূল সমস্যাগুলো হলো:

  • ব্যক্তিগত উদ্যোগের অবসান: এই ব্যবস্থা ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা এবং উদ্যোগকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। যখন ভালো-মন্দ কাজের পুরস্কারে কোনো পার্থক্য থাকে না, তখন মানুষ তার সেরাটা দেওয়ার প্রেরণা হারিয়ে ফেলে। এর অনিবার্য ফল হলো মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তিক অধঃপতন। বক্তা আরও গভীরে গিয়ে বলেন, এটি “বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতার ক্রমাগত অবক্ষয়” ঘটায়, কারণ মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তিক গুণাবলী, যা প্রায়শই বংশপরম্পরায় সঞ্চারিত হয়, সেগুলোকে উৎসাহিত করার কোনো সুযোগই এই ব্যবস্থায় থাকে না।
  • জবরদস্তি ও সহিংসতা: বলশেভিক ব্যবস্থা শক্তি এবং সহিংসতার উপর প্রতিষ্ঠিত। মানুষের সম্পত্তি জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়, যা সমাজে তিক্ততা, ঘৃণা এবং বিপর্যয় ডেকে আনে।
  • ধর্মবিরোধিতা: এই ব্যবস্থাটি ছিল মৌলিকভাবে ধর্মবিরোধী। ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের কোনো রকম সামাজিক অধিকার দেওয়া হতো না এবং শিশুদেরকে অল্প বয়স থেকেই ধর্মহীন শিক্ষা দিয়ে বড় করা হতো।
  • স্বৈরতন্ত্রের জন্ম: এই ব্যবস্থাটি শেষ পর্যন্ত কঠোর একনায়কতন্ত্রের জন্ম দেয়। তত্ত্বের দিক থেকে এটি জনগণের শাসনের কথা বললেও, বাস্তবে লেনিন এবং স্তালিনের মতো একনায়কদের হাতেই সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল।
  • শ্রেণী-সংগ্রামের বিস্তার: কমিউনিজম শ্রেণী-সংগ্রাম শেষ করার পরিবর্তে তাকে আরও উসকে দেয়। এটি ধনী শ্রেণীকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে এক নতুন ধরনের বিভেদ তৈরি করে।

আজকের দিনে যখন আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কারণ বিশ্লেষণ করি, তখন দেখি, ১৯৪২ সালের এই কথাগুলো কতটা নির্ভুল ছিল। এটি এক শক্তিশালী ঐতিহাসিক দলিল যা আজও প্রাসঙ্গিক।

শুধু রাষ্ট্রীয় মতাদর্শই নয়, তৎকালীন প্রধান ধর্মগুলোর অর্থনৈতিক দর্শনকেও বক্তা একইভাবে বিশ্লেষণ করেছিলেন।

প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের আয়নায় অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার

ভাষণটির বিশ্লেষণ অনুসারে, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে তৎকালীন প্রধান ধর্মগুলো (তাদের প্রচলিত রূপ অনুযায়ী) কেন একটি সার্বজনীন সমাধান দিতে পারেনি, তা-ও তুলে ধরা হয়।

  • ইহুদি ধর্ম: এই ধর্মের ব্যবস্থাটিকে “সম্পূর্ণরূপে জাতিগত” বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এর নিয়মকানুন সার্বজনীন নয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন ইহুদি অন্য ইহুদির কাছ থেকে সুদ নিতে পারবে না, কিন্তু অ-ইহুদিদের কাছ থেকে সুদ নেওয়া বৈধ। এটি প্রমাণ করে যে এর সুবিধাগুলো শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট জাতির জন্য সীমাবদ্ধ।
  • খ্রিস্টধর্ম: খ্রিস্টধর্মের মূল বার্তা হলো “আইন একটি অভিশাপ” (The Law is a curse)। যেহেতু এখানে কোনো সুনির্দিষ্ট আর্থ-সামাজিক আইন বা কর্মসূচি নেই, তাই এটি সময়ের সাথে সাথে প্রভাবশালী ব্যবস্থার সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়। এর নিজস্ব কোনো অর্থনৈতিক মডেল নেই।
  • হিন্দুধর্ম: বক্তার মতে, হিন্দুধর্মের কর্মফল এবং বর্ণপ্রথার ধারণাগুলো মানুষের উন্নতি এবং সাম্যের পথে একটি বড় বাধা তৈরি করে। কর্মফলের ধারণা অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি তার পূর্বজন্মের কর্মের ফলে ধনী বা দরিদ্র হয়, যা তার বর্তমান অবস্থাকে পরিবর্তনের অযোগ্য বলে ধরে নেয়। বর্ণপ্রথা সমাজে উঁচু-নিচু ভেদাভেদকে স্থায়ী করে তোলে। এই প্রসঙ্গে মনুস্মৃতির একটি ভয়ংকর শ্লোক উদ্ধৃত করা হয়েছে:

এই প্রেক্ষাপটে, বক্তা ইসলামের দিকে ফিরেছিলেন এবং দেখিয়েছিলেন কীভাবে এটি দাসপ্রথার মতো একটি জটিল সামাজিক সমস্যার মোকাবেলা করেছিল।

দাসপ্রথা উচ্ছেদের এক যুগান্তকারী ইসলামী কৌশল

বক্তা তার ভাষণে দাবি করেন যে ইসলামই একমাত্র ধর্ম যার শিক্ষাগুলো সরাসরি দাসপ্রথার প্রাতিষ্ঠানিক বিলুপ্তির দিকে পরিচালিত করেছিল।

তবে এর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত রয়েছে। ইসলাম শুধুমাত্র আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের অনুমতি দেয়, বিশেষ করে সেই যুদ্ধ যা ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার জন্য করা হয়। কুরআনের ভাষায়, “…যদি আল্লাহ মানবজাতির একদলকে অন্য দলের দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহলে আশ্রম, গির্জা, সিনাগগ এবং মসজিদসমূহ—যেখানে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয়—অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যেত।” এই প্রেক্ষাপটটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি যুদ্ধবন্দীদের বিষয়টি কোনো завоевания বা আগ্রাসনের অংশ হিসেবে নয়, বরং ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার একটি অনিবার্য পরিণতি হিসেবে তুলে ধরে।

প্রাতিষ্ঠানিক দাসপ্রথা এবং একটি আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধে আটককৃত যুদ্ধবন্দীদের (POW) মধ্যে তিনি একটি স্পষ্ট পার্থক্য তুলে ধরেন। যুদ্ধবন্দী নেওয়া যুদ্ধের একটি প্রয়োজনীয় অংশ, কিন্তু ইসলাম তাদের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে সে বিষয়ে অত্যন্ত মানবিক বিধান দিয়েছে। এই বিধানগুলোই ধীরে ধীরে দাসপ্রথাকে নির্মূল করে।

যুদ্ধবন্দীদের জন্য নির্ধারিত শর্তগুলো ছিল নিম্নরূপ: ১. যুদ্ধ শেষ হলে, তাদের হয় অনুগ্রহ করে অথবা মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্ত করে দিতে হবে। ২. তাদের সেই মানের খাবার এবং পোশাক দিতে হবে যা তাদের আটককারীরা নিজেরা গ্রহণ করে। ৩. কোনো বন্দীকে আঘাত করলে বা চড় মারলে সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুক্তি পেয়ে যাবে। ৪. তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। ৫. একজন বন্দী কিস্তিতে মুক্তিপণ পরিশোধ করে সর্বদা তার স্বাধীনতা অর্জন করতে পারত।

এই ঐতিহাসিক perspectiva আজকের দিনের প্রচলিত ধারণা থেকে অনেকটাই ভিন্ন এবং এটি দাসপ্রথার মতো একটি জটিল বিষয়কে একটি নতুন আলোকে দেখার সুযোগ করে দেয়।

দাসপ্রথার মতো একটি প্রাতিষ্ঠানিক অন্যায়ের অবসানের পর, বক্তা মূল অর্থনৈতিক বৈষম্যের সমাধানে মনোনিবেশ করেন, যা ছিল তার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।

এক তৃতীয় পথ: রাষ্ট্রীয় জবরদস্তি নয়, ঐচ্ছিক ত্যাগের বিপ্লব

এটিই ছিল বক্তৃতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং যুগান্তকারী ধারণা। এখানে পুঁজিবাদী শোষণ এবং কমিউনিস্ট জবরদস্তির বাইরে একটি তৃতীয় পথের প্রস্তাব করা হয়, যা এক শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

এই নতুন বিশ্বব্যবস্থার ভিত্তি হলো আল-ওসিয়াত (The Will) নামক একটি প্রতিষ্ঠান, যা আহমদিয়া আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ১৯০৫ সালে চালু করেছিলেন। এর পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে ১৯৩৪ সালে তহরিক-ই-জাদিদ (নব উদ্যোগ) নামক একটি প্রকল্প এর অগ্রদূত হিসেবে চালু করা হয়েছিল।

এর মূল কার্যকারিতাটি হলো: বিশ্বাসীরা স্বেচ্ছায় তাদের সম্পত্তি এবং/অথবা আয়ের দশ ভাগের এক ভাগ (১/১০) থেকে শুরু করে তিন ভাগের এক ভাগ (১/৩) পর্যন্ত একটি কেন্দ্রীয় তহবিলে দান করার জন্য উইল বা অঙ্গীকার করেন।

এই তহবিলের উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে: “কুরআনের শিক্ষার প্রসার, ইসলামী সাহিত্যের প্রচার এবং ইসলামী মিশন স্থাপনের মাধ্যমে ইসলামের ভিত্তি শক্তিশালী করা” এবং সেইসাথে “এতিম ও দরিদ্র, যাদের জীবিকা নির্বাহের পর্যাপ্ত উপায় নেই” তাদের কল্যাণে ব্যয় করা।

এই ব্যবস্থাটি বলশেভিক ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন:

  • স্বেচ্ছামূলক বনাম জবরদস্তিমূলক: এই ব্যবস্থাটি রাষ্ট্রীয় জবরদস্তির মাধ্যমে সম্পত্তি কেড়ে নেওয়ার উপর ভিত্তি করে নয়, বরং সৃষ্টিকর্তাকে খুশি করার জন্য মানুষের স্বেচ্ছায় ত্যাগের উপর প্রতিষ্ঠিত।
  • সদিচ্ছা বনাম তিক্ততা: জোর করে সম্পত্তি কেড়ে নিলে সমাজে ঘৃণা ও তিক্ততা তৈরি হয়। অন্যদিকে, স্বেচ্ছায় দান করলে বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে স্নেহ ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়।
  • উদ্যোগকে বাঁচিয়ে রাখা: এই ব্যবস্থা ব্যক্তিগত মালিকানা এবং উদ্যোগকে উৎসাহিত করে, যা কমিউনিজমের মতো মেধাশূন্যতা তৈরি করে না।

এই পরিকল্পনার পেছনে যে ঐশ্বরিক আস্থা ছিল, তা বোঝানোর জন্য আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতার এই উদ্ধৃতিটি ব্যবহার করা হয়:

“মনে করো না যে এটি একটি কাল্পনিক ধারণা। এটি সেই সর্বশক্তিমান সত্তার আদেশ, যিনি আকাশ ও পৃথিবীর শাসক। আমি এই ভেবে চিন্তিত নই যে এত সম্পত্তি কীভাবে সংগৃহীত হবে… আমি যা নিয়ে চিন্তিত তা হলো, আমাদের সময়ের পরে, যাদেরকে এই তহবিলের দায়িত্ব দেওয়া হবে, তারা এর বিশাল পরিমাণ দেখে প্রলুব্ধ হতে পারে…”

আমাদের সময়ের জন্য একটি শেষ ভাবনা

১৯৪২ সালের এই বক্তৃতাটি একটি অনন্য, বিশ্বাস-ভিত্তিক এবং স্বেচ্ছাসেবী আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার প্রস্তাব করেছিল, যা বিংশ শতাব্দীর সহিংস ও জবরদস্তিমূলক মতাদর্শগুলোর একটি শক্তিশালী বিকল্প হতে পারত। এটি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে মানুষের নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির মাধ্যমে এক ন্যায্য সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখিয়েছিল।

এই ঐতিহাসিক ধারণাগুলো নিয়ে ভাবার পর একটি প্রশ্নই মনে আসে:

আজকের বিভক্ত পৃথিবীতে, রাষ্ট্রীয় জবরদস্তির পরিবর্তে স্বেচ্ছায় ত্যাগের উপর ভিত্তি করে কি এক নতুন, মানবিক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব?

Leave a Comment