
এক বিশৃঙ্খলা ও সৌন্দর্যে পূর্ণ জগতে, এক প্রশ্ন তারার চেয়েও বৃহৎ হয়ে দাঁড়ায়: আমরা এখানে কেন? জীবনের দৈনন্দিন কর্মযজ্ঞের নীচে, এই প্রশ্ন থেকে যায়—পুরনো সময়ের ধ্বংসাবশেষের মধ্য দিয়ে বাতাসের ফিসফিসের মতো অনড়। এই প্রশ্ন মানবতার মতোই প্রাচীন, তবু প্রতি বার যখন আমরা এটি করতে সাহস করি, এটি নতুন মনে হয়। একজন স্রষ্টা কি আছেন? থাকলে, কেন তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন?
চলুন, আমরা একটি সুবর্ণ সূতোর বুননে জড়ানো এক গালিচার সন্ধানে যাই। এই সূতোর সূত্রপাত হয়েছে হযরত মির্যা বশিরুদ্দীন মাহমুদ আহমদ (র.আ.)-এর বিস্তৃত তাফসির-ই-কবীর থেকে, যা সৃষ্টির উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে। একই সঙ্গে রয়েছে হযরত মির্যা গুলাম আহমদ (আ.), প্রতিশ্রুত মসীহ ও মাহদী, যাঁর লেখনীতে উঠে এসেছে আধ্যাত্মিক সত্যের এক অনন্য প্রকাশ। এই মহৎ কণ্ঠস্বরগুলি আমাদের অস্তিত্বের অন্তঃস্থলে পৌঁছে দেয়।
—
প্রথম ফিসফিস: ভালোবাসার প্রকাশ
শুরুটা ঝড়ো নয় বা ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টির কোনো গর্জন দিয়ে নয়, বরং একটি ফিসফিস দিয়ে—একটি ঐশী ফিসফিস। কোরআন ঘোষণা করে:
“আমি জ্বিন এবং মানুষকে শুধুমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি” (৫১:৫৭)।
তাফসির-ই-কবীরের ব্যাখ্যায় বোঝা যায়, এই ইবাদত কেবল আনুষ্ঠানিক প্রার্থনা নয়, এটি এক ধরনের প্রেমের গান, যা স্রষ্টার গুণাবলির প্রতিফলন।
সৃষ্টি হল স্রষ্টার একটি প্রেমপত্র, যা তিনি তাঁর সৃষ্টিকে জানিয়েছেন। প্রতিটি পরমাণু, প্রতিটি নক্ষত্র, প্রতিটি হৃদয়ের ধ্বনি—সবই তাঁর গুণাবলির স্বাক্ষর। স্রষ্টা সৃষ্টি করেন কারণ ভালোবাসা কখনও লুকিয়ে থাকতে পারে না; এটি উন্মোচিত হতে চায়, বিকশিত হতে চায়।
—
দ্বিতীয় দৃষ্টি: মানবজাতির উত্থান
কিন্তু কেন আমাদের মতো নশ্বর প্রাণীদের সৃষ্টি করা হল? হযরত মির্যা গুলাম আহমদ (র.আ.) লিখেছেন,
“মানবজাতি হল সৃষ্টির মুকুট কারণ সে সেই পাত্র যা স্রষ্টার আলো ধারণ করতে পারে।”
মাটির নিচে থাকা একটি বীজের মতো, যা মাটি ফুঁড়ে বেড়িয়ে আসে, মানবজীবনও শারীরিক স্তর থেকে আধ্যাত্মিক স্তরে উন্নীত হওয়ার জন্য ডিজাইন করা।
জীবন এক সিঁড়ির মতো, প্রতিটি ধাপ আমাদের অনন্তের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু এই সিঁড়ি সহজ নয়। আমরা হোঁচট খাই, পড়ে যাই, আবার উঠে দাঁড়াই। এই যাত্রাকে অর্থবহ করে তোলার জন্য রয়েছে আমাদের ইচ্ছাশক্তি—যা একাধারে আশীর্বাদ ও পরীক্ষা। এটি স্রষ্টার দয়া, ধৈর্য এবং ন্যায়ের প্রতিফলন।
—
তৃতীয় রহস্য: কষ্টের অর্থ
কিন্তু কেন আমাদের কষ্ট পেতে হয়? এক প্রেমময় স্রষ্টা কেন আমাদের জীবনে ঝড়-ঝঞ্ঝা পাঠান? এখানে রয়েছে অস্তিত্বের গভীরতম এক রহস্য।
হযরত মির্যা বশিরুদ্দীন মাহমুদ আহমদ (র.আ.) বলেছেন,
“কষ্ট হল সেই আগুন যেখানে আত্মা পরিশুদ্ধ হয়।”
পরীক্ষা ছাড়া সাহস, ধৈর্য এবং কৃতজ্ঞতার মতো গুণাবলি কখনও বিকশিত হতে পারে না।
কোরআন প্রতিশ্রুতি দেয়:
“নিশ্চয়ই, কষ্টের সঙ্গে রয়েছে স্বস্তি” (৯৪:৭)।
এমনকি গভীরতম হতাশার রাতও নতুন ভোরের পূর্বাভাস। প্রতিটি অশ্রু স্রষ্টার কাছে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার স্মারক, যা এই অস্থায়ী পৃথিবীর অসারতার কথা মনে করিয়ে দেয়।
—
চতুর্থ প্রশ্ন: মানবজাতি কি স্রষ্টার জন্য প্রোগ্রামড?
তারপর আসে সেই চিরন্তন প্রশ্ন—”কেন?” আমাদের কি এমন কিছু রয়েছে যা আমাদের বাধ্য করে অর্থ খুঁজতে, তারার দিকে তাকিয়ে ভাবতে? কোরআন উত্তর দেয়:
“এবং আমি মানুষকে আমার আত্মার অংশ দিয়ে পূর্ণ করেছি” (১৫:৩০)।
এই ঐশী স্ফুলিঙ্গ আমাদের মধ্যে বিদ্যমান। এটি কখনও চুপ থাকতে পারে না।
হযরত মির্যা গুলাম আহমদ (র.আ.) এটিকে আমাদের ফিতরাহ (স্বভাবজাত প্রবৃত্তি) বলেছেন। এই প্রবৃত্তিই দার্শনিকদের স্বপ্ন দেখায়, বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করে, এবং কবিদের ব্যথিত করে তোলে। এই প্রশ্নটাই প্রমাণ যে উত্তরদাতা (স্রষ্টা) আছেন।
—
পঞ্চম প্রকাশ: বিজ্ঞান ও ঈমানের সহযাত্রা
বিজ্ঞান—যা অনেকেই সেক্যুলার মনে করেন—তাও ঐশ্বরিক সত্যের ফিসফিস করে। ব্রহ্মাণ্ড, তার সূক্ষ্ম ভারসাম্য এবং জটিল নিয়মাবলি, এক স্রষ্টার উদ্দেশ্যপূর্ণ সিম্ফনি গায়।
কোরআন বলে:
“তিনি সবকিছু সঠিক অনুপাতে সৃষ্টি করেছেন” (২৫:৩)।
হযরত মির্যা বশিরুদ্দীন মাহমুদ আহমদ (র.আ.) এটিকে স্রষ্টার প্রজ্ঞার প্রমাণ হিসেবে দেখিয়েছেন। বিজ্ঞান, তাঁর মতে, স্রষ্টার মনের প্রতিফলন। এটি দৃশ্যমান ও অদৃশ্যের মধ্যে একটি সেতু।
—
শেষ দিগন্ত: অনন্ত যাত্রা
আহমদিয়াতের লেখনী আমাদের বলে, সৃষ্টি স্থির নয়; এটি একটি চলমান গল্প। জীবনের উদ্দেশ্য কোনো গন্তব্য নয় বরং এটি এক অনন্ত যাত্রা। এমনকি পরকালেও আত্মা তার অনন্ত যাত্রায় ঈশ্বরের কাছাকাছি যেতে থাকে।
কোরআনের প্রতিশ্রুতি চিরন্তন:
“তোমার রবের দিকে পৌঁছানোই চূড়ান্ত লক্ষ্য” (৫৩:৪৩)।
—
ধ্যান করো, খোঁজ করো, এবং ওঠো।
এই পৃথিবীতে তুমি কোনো দুর্ঘটনা নও; তুমি স্রষ্টার পরিকল্পনার অংশ। প্রশ্নটা আর “তোমাকে কেন সৃষ্টি করা হয়েছে?” নয়। প্রশ্ন হলো: “তোমার সৃষ্টির এই উপহার দিয়ে তুমি কী করবে?”
Zajakallah
LikeLike